১১০ কিমি রিকশা চালিয়ে মেয়েকে হাসপাতালে আনলেন বাবা

১১০ কিমি রিকশা চালিয়ে মেয়েকে হাসপাতালে আনলেন বাবা

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি: অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার টাকা না থাকায় নয় ঘণ্টায় ১১০কিলোমিটার রিকশায় ঠাকুরগাঁও থেকে রংপুর মেডিক্যালে আসা অসুস্থ শিশুর চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেন রংপুরের জেলা প্রশাসক মো. আসিব আহসান।

গত রবিবার দুপুরে জেলা প্রশাসন, রংপুরের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদ হাসান মৃধা অসুস্থ শিশুটিকে দেখতে যান। এসময় তিনি শিশুটির মায়ের হাতে পাঁচ হাজার টাকা তুলে দেন। জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে নিয়মিত শিশুটির চিকিৎসার বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে।

উল্লেখ্য যে শনিবার সকাল ৬ টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে ১১০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ পাড়ি দিয়ে বেলা সোয়া তিনটায় রংপুরে পৌঁছান তিনি। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বারবার হু-হু করে কাঁদতে থাকেন বাবা তারেক ইসলাম। সাত মাস বয়সী শিশু জান্নাত রক্ত পায়খানা করায় গত ১৩ এপ্রিল রাতে ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে একদিন চিকিৎসা দেওয়ার পর চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য জান্নাতকে রংপুর মেডিক্যালে পাঠান করেন।

কিন্তু লকডাউন পরিস্থিতিতে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার টাকা না থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েন বাবা তারেক। চার দিন ধরে কোনো ব্যবস্থা করতে না পেরে অবশেষে নিজে রিকশা চালিয়ে সন্তানকে নিয়ে রংপুরে আসেন। শনিবার বিকেল সোয়া তিনটার দিকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে সন্তানকে কোলে নিয়ে ছুটোছুটি করতে দেখা যায় বাবা তারেককে। তার সঙ্গে থাকা অন্য স্বজনদের চোখে মুখে তখন দীর্ঘ নয় ঘণ্টা রিকশায় চড়ে আসার ক্লান্তির ছাপ।

তারেক বলেন, লকডাউনের কারণে অসুস্থ বাচ্চাকে অনেক কষ্ট করে রংপুরে নিয়ে এসেছি। আমি রিকশা চালাই। অ্যাম্বুলেন্সে করে বাচ্চাকে নিয়ে আসার মতো সামর্থ্য নেই আমার। চার দিন আগেই ডাক্তার বাচ্চাকে রংপুরে নেয়ার জন্য বলেছিল। প্রথমে বাচ্চাকে ডাক্তার দেখানো ও ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে ভর্তি করানোর সময় অন্যের কাছ থেকে পাঁচশ টাকা ধার নিয়েছিলাম।

অসহায় তারেক বলেন, শুক্রবার (১৬ এপ্রিল) রাতে ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতাল থেকে রাতে বাচ্চাকে নিয়ে বাসায় যাই। বাচ্চার কন্ডিশন দেখে আমি চিন্তিত হয়ে পরি। কিন্তু লকডাউনোর কারণে আমার অবস্থা এতটাই খারাপ যে কালকে কি খাবো সেই টাকাও আমার কাছে নেই। এ অবস্থায় আমি কীভাবে বাচ্চাটাকে নিয়ে এত দূরের রাস্তা আসবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। অ্যাম্বুলেন্সের টাকা জোগাড় করতে না পেরে সন্তানকে বাঁচানোর জন্য রিকশা চালিয়ে রংপুরে আসার সিদ্ধান্ত নেই।

তিনি আরও বলেন, সকাল ছয়টার দিকে আল্লাহর নাম দিয়ে বাসা থেকে বের হই। রাস্তায় আসতে আসতে তারাগঞ্জের দিকে এসে রিকশায় সমস্যা দেখা দেয়। পরে এক অটোরিক্সা চালক বাচ্চার সমস্যার কথা শুনে আমাকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ এগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছার জন্য বাঁধ্য হয়ে দুই-তিন কিলোমিটার রাস্তা রিকশা ঠেলে নিয়ে আসি। পথিমধ্যে আরেকটা গাড়ি আমাকে মেডিক্যাল পৌঁছানোর জন্য সহযোগিতা করেন। প্রায় নয় ঘণ্টা পর বাচ্চাকে নিয়ে হাসপাতালে এসে পৌঁছেছি।

জরুরি বিভাগ থেকে ভর্তির রশিদ নিয়ে দ্রুত হাসপাতালের পাঁচতলার শিশু বিভাগে শিশু জান্নাতকে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক দেখার পর কিছু ওষুধ ও স্যালাইন দিয়েছেন। আজকের পর্যবেক্ষণ শেষে অপারেশন করা লাগতে পারে বলে চিকিৎসকের উদ্ধৃতি দিয়ে এ কথা জানান তারেক ইসলাম। কিন্তু অপারেশন করার মতো টাকা তার কাছে নেই। এমনকি চিকিৎসকের লিখে দেওয়া প্রাথমিক পর্যায়ের ওষুধ, স্যালাইন, ইঞ্জেকশন কেনার জন্য টাকাও নেই।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার দক্ষিণ সালন্দর গ্রামের রামবাবুর গোডাউন এলাকার আনোয়ার হোসেনের বড় ছেলে তারেক ইসলাম। তিনি ১২ বছর বয়সেই রিকশা প্যাডেল ঘুরিয়ে বাবার সংসারের বোঝা সামলানোর যুদ্ধ শুরু করেন। বিয়ের পর স্ত্রী সুলতানা বেগমকে নিয়ে আলাদা থাকা শুরু করে। সংসার জীবনে তার নয় বছর ও তিন বছর বয়সী আরও দুই মেয়ে সন্তান রয়েছে। তারেক রিকশা চালানোর পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ওয়াজ মাহফিলে সাউন্ড সিস্টেম অপারেটর হিসেবে কাজ করত।

কিন্তু করোনা মহামারী শুরুর পর থেকে অনুষ্ঠান না থাকায় তার বাড়তি আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে লকডাউন পরিস্থিতিতে ঠিকমতো রিকশা চালাতে না পেরে অসহনীয় কষ্ট নেমে এসেছে তার পরিবারে। অসহায় রিকশাচালক তারেক ইসলাম তার অসুস্থ শিশু জান্নাতকে বাঁচানোর জন্য সমাজের বিত্তবান ও দানশীল মানুষদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমার তো সামর্থ্য নেই বাচ্চার অপারেশন করাবো। যদি সমাজের বিত্তবান মানুষেরা এগিয়ে আসে আমি জান্নাতকে বাঁচাতে পারবো। বাচ্চার হাসি মাখা মুখটা দেখতে পারবো।

বিআলো/শিলি