কর্পোরেট ক্যারিয়ার : প্রস্তুতি ও করণীয় 

কর্পোরেট ক্যারিয়ার : প্রস্তুতি ও করণীয় 

 

-শেখ মোহাম্মদ সাব্বির হোসেন :

চাকরীর বাজারে বর্তমানে বাংলাদেশের প্রথম পছন্দ- সরকারী চাকরী। আরও কেন্দ্রীভূত করলে- বিসিএস এর মাধ্যমে ক্যাডারভূক্ত চাকরী। যারা মেধা, পরিশ্রম বা ফলাফলে একটু পিছিয়ে থাকার কারণে বিসিএস এর স্বপ্ন দেখতে পারে না- তাদেরও প্রথম পছন্দ সরকারী চাকরীই- হোক সে ননক্যাডার, দ্বিতীয়, বা তৃতীয় শ্রেনী। এমনকি সরকারী চাকরীতে চতুর্থ শ্রেনী বা এমএলএসএস পদেও প্রচুর স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারীরা পূর্ণ সন্তষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছে। তারপরও কিছু সংখ্যক মানুষ চাকরীর ব্যাপারে ভিন্ন ইচ্ছা লালন করে। তাদের কেউ সাংবাদিকতা, কেউ ব্যাংকিং আবার কেউ ডিফেন্স বা কর্পোরেট সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী। প্রতিটি সেক্টরে ক্যারিয়ার শুরু করার প্রস্তুতির মূলনীতি প্রায় একই- লেখাপড়া, অংক, ইংরেজী, সাধারণ জ্ঞান ও সমসাময়িক ইস্যুতে ভাল দখল থাকা, নিজের বাহ্যিক বেশভূষা পরিপাটি করা, শুদ্ধ ও স্বতঃস্ফূর্ত কথাবার্তা। তবে ক্যারিয়ার শুরু পরে তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্ট্র্যাটেজী সেক্টরভেদে ভিন্ন হবে। যার স্ট্র্যাটেজী যত নির্ভুল হবে সে তত দ্রুত এগিয়ে যাবে। স্ট্র্যাটেজীগত নৈপূন্যতার ভিন্নতার কারণে একই যোগ্যতাসম্পন্ন দুজন মানুষ একই সময়ে একই সেক্টরে যোগদানের পরও একজন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায়, আরেকজন পড়ে থাকে যোজন যোজন পেছনে। 

কর্পোরেট সেক্টরে ক্যারিয়ার গঠনে একজন এমপ্লয়ীকে চৌকষ হতে হবে, সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে এবং সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে। এই সেক্টরে উপরে উঠার জন্য শালীনতার মোড়কে চলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। "সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট" বাক্যটি এই সেক্টরের জন্য পরিপূর্ণভাবে প্রযোজ্য। হয় আপনাকে উপরে উঠে যেতে হবে, নয়তো নীচে পড়ে যেতে হবে। মাঝখানে ঝুলে থাকার সুযোগ এখানে কম। আপনি যদি উপরের দিকে উঠার যোগ্যতাসম্পন্ন না হন, যে কোন দূর্যোগকালের এক ঝকঝকে সকালে গোটা গোটা হরফের এক চিঠির মাধ্যমে তারা আপনার সাথে ব্রেকাপ করবে। কর্পোরেট সেক্টরে ক্যারিয়ার গঠন ও দ্রুত উত্থানের জন্য আপাতঃ দৃষ্টিতে কিছু শ্রুতিকটু বা দৃষ্টকটু কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। আপাতঃ দৃষ্টিতে সেই শ্রুতিকটু বা দৃষ্টকটু কৌশলগুলো যে যতটা শৈল্পিকভাবে প্রয়োগ করতে পারবে-সে ততবেশী সফল হবে। পুরুষ ও নারীভেদে আবার কৌশল ও তার প্রয়োগ ভিন্ন হয়। নারীদের কথাবার্তা চলাফেরা এবং ড্রেসআপ-গেটআপ

-এ একটু স্মার্ট, একটু উদার মানসিকতা একটু চটপটে হলেই অনেকদূর যাওয়া সম্ভব। দ্রুত ও শর্টকাট ক্যারিয়ার গঠনে এটা একটা অপশনাল বিষয় বিধায় নারীবাদী বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে আপত্তি উত্থাপন বাহুল্য হবে। নারীদের এই বিশেষ যোগ্যতাটুকু বাদ দিলে, বাকী যোগ্যতাগুলো পুরুষ নারী নির্বিশেষে। বাকী যোগ্যতাগুলোর মধ্যে প্রথমেই থাকতে হবে শো-অফ করার যোগ্যতা। আপনি কাজ করেন বা না করেন, উর্ধ্বতন যেন মনে করেন-আপনি কাজ করছেন। আপনার কথাবার্তা থেকে ছুটোছুটি সর্বত্রই প্রতিষ্ঠানের জন্য আপনার টেনশন পরিস্ফুটিত হতে হবে, আপনার ডেডিকেশন পরিলক্ষিত হতে হবে। বিষয়টা এমন না যে কাজ না করে শুধু ভাব প্রদর্শনেই কাজ হবে। বিষয়টা হচ্ছে-আপনার উপর এসাইনড করা কাজ আপনি সুচারুভাবে করবেন এবং যা করলেন তার চাইতে আপনার প্রকাশটা অনেক বেশি হবে, যাতে মনে হবে কাজটা করতে আপনাকে যথেষ্টই বেগ পেতে হয়েছে, তবে ব্যাপার না, প্রতিষ্ঠানের জন্য এরচে বেশী বেগ পেতে আপনি তৈরি আছেন। অর্থাৎ আপনার এপ্রোচিং এবং এক্সপ্রেশন ম্যাটারস। ধরুন আপনার রিক্রূটমেন্ট কিংবা প্রমোশন ভাইভা হচ্ছে এবং আপনার কাজ বা প্রয়োজনীয় ইস্যুতে আপনি যথেষ্ট দক্ষ ও ওয়াকিবহাল। ভাইভা'র ওই পাঁচ মিনিটে কতটুকু প্রকাশ করতে পারলেন,কতটা দৃষ্টিনন্দনভাবে প্রকাশ করতে পারলেন, কতটুকু আত্মবিশ্বাসের সাথে প্রকাশ করতে পারলেন- সেটাই আপনার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দিবে। আপনি প্রকাশ করতে পারলেন না, নো ম্যাটার হাউ এফিসিয়েন্ট ইউ আর- আপনি শেষ। রবীন্দ্রনাথের গান- ক্যামনে প্রকাশি কব কত ভালবাসি গাইতে গাইতে দেখবেন- আপনার ভালবাসা অন্যের ঘরে।

আপনার উপরোক্ত সব অর্জন মাটি হয়ে যেতে পারে- যদি আপনার সুপিরিয়র বা লাইন ম্যানেজার আপনার উপর অসন্তুষ্ট হন। কাজেই "নেভার গো ফর এন আর্গুমেন্ট উইদ ইওর বস"। আর কোনো বিষয়ে যদি দ্বিমত পোষন জরুরী হয়েই পড়ে- তাহলে সেটা অশ্লীলতাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার মত করে করেন। "বাট ইউর বস শুড নেভার বি এনোয়েড উইদ ইউ ইন এনি ম্যাটার ইন এনি পয়েন্ট অব টাইম থ্রো আউট দ্য ইয়ার"। আপনি তেল দিতে পারেন না, তেল দেয়া আপনার পক্ষে সম্ভব না, তেল দেয়া আপনার ব্যক্তিত্বের সাথে যায় না- এসব ভেবে আপনি যদি আত্মতুষ্টি লাভ করেন, করতে পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে টিকিয়া থাকাই হইবে আপনার জন্য চরম স্বার্থকতা। আপনি তেল দিয়ে আপনার স্বার্থ উদ্ধার করলে, যারা আপনাকে সমালোচনার খোরাক বানাবে, তাদের দিকে তাকিয়ে দেখুন-তারা আসলে প্রকৃত লুজার। ও হ্যাঁ, ভাল কথা, আপনি সফল হচ্ছেন কিনা, সাফল্যের পানে যাচ্ছেন কি না- এটা মাপার প্যারামিটার হচ্ছে আপনার চারপাশের বাঁকা দৃষ্টি, ফিসফাস শব্দ ও শত্রু বৃদ্ধি।

এখানে একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। উপরোক্ত কৌশলগুলো সাধারণ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যেখানে প্রয়োগকারীর মেধা একটা গ্রহনযোগ্য লেভেলে থাকতে হবে। ব্যতিক্রমক্ষেত্রে এই কৌশলগুলো ছাড়াও কেউ কেউ নিজ মেধা ও কর্মগুনে কিংবা অন্যকোন অনুঘটকের দ্বারা দ্রুত উন্নতি অর্জনে সক্ষম হতে পারে।

উপরের বিষয়গুলো সামারাইজ করলে, যা বের হবে, তা হচ্ছে- কাজ, ভাব, প্রকাশ এবং তোষামোদ- এগুলির যথাযথ সংমিশ্রণ ও সফল প্রয়োগ আপনাকে আপনার সর্বোচ্চ অর্জনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করবে। মনে রাখবেন, "পারা আর না পারাতে যোজন যোজন দূর"॥ লেখকঃ এভিপি এন্ড ম্যানেজার, ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিঃ।