ঠাকুরগাঁওয়ে সংগ্রামী নারী মোকসেদার গল্প

ঠাকুরগাঁওয়ে সংগ্রামী নারী মোকসেদার গল্প

বিকাশ রায় চৌধুরী, ঠাকুরগাঁও ঃ কিশোরী মনটা তখন উজ্জীবিত। স্কুলের বান্ধবীদের সঙ্গে গল্প করেই কাটত দিনের অধিকাংশ সময়। অষ্টম শ্রেণীতে সবে পা দেয়া। বয়স চৌদ্দ। মেয়ে বলে খুব বেশি দিন বাড়িতে রাখতে নারাজ বাবা। এ এক রকমই এক দিন স্কুল থেকে এসে নিজের বিয়ের কথা শুনে বিমর্ষ হয়ে পড়ে মেয়েটি। কোনো কিছু বলার বা মতামত দেয়ার ফুরসত টুকুও সেদিন দেয়া হয়নি তাকে। যে বয়সে এ গ্রাম ও গ্রাম বেনি দুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কথা, আর এ বয়সে বসতে হয়েছে বিয়ের পিড়িতে। অপ্রত্যাশিত ভাবেই বউ সেজে যেতে হয় শশুর বাড়িতে।
গল্পটি  ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গোবিন্দ নগর মুন্সির হাট গ্রামের মোকসেদা বেগমের।
বিয়ের দশ বছরের মাথায় স্বামী চলে যান না ফেরার দেশে। আর অল্প বয়স্ক মোকসেদা বেগমের কাধেঁ পড়ে পুরো সংসারের দায়িত্ব। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে অথৈই সমুদ্রে একলা নাবিক তিনি। শশুর বাড়িতে ঠাঁই হয় না। আত্মসম্মানের কথা ভেবে বাবার বাড়িতেও যেতে নারাজ মোকসেদা। ¯্রােতের বিপরীতে দাড়ঁ বেয়ে সন্ধান করেন কুলের। স্থাণীয় এক এনজিওতে ছোট্ট কাজ জোটে তার। এতে সংসার ভালো চলছিলোনা। অভাব আর নিসংগতা তাকে সবসময় তাড়া করছিলো। এক সময় পরিকল্পনা করেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে। যেই ভাবনা সেই কাজ। আত্মপ্রত্যয়ী মোকসেদা শুরু করেন স্বপ্নের ফুল ফোটাতে। সে জন্য পুঁজি ও কারিগরি শিক্ষা দুটোরই প্রয়োজন।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে ছয় মাসের সেলাই প্রশিক্ষণ গ্রহন করে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেন, আর সংগঠিত করেন তারই এলাকার ১০ জন অসহায় নারীকে। পুঁজি  আর জনবল নিয়ে ২০০০ হাজার সালে শুরু করেন অনন্যা শিল্প নামে ক্ষুদ্র একটি সেলাই কারখানার যাত্রা। নকশী কাঁথা, বালিশের কুশন, মহিলাদের ব্যাগ, বেড সীট, টুপি,মোবাইল ব্যাগ ইত্যাদি পণ্য তৈরি করছে মোকসেদা। তবে গল্পটি যত সহজে বলা গেল বাস্তবতা অতটা মসৃণ ছিলো না মোকসেদার জন্য। চোখ মুছে বলেন, মোকসেদা নারী হিসেবে ব্যবসা করার বিষয়টি সমাজ খুব সহজ ভাবে মেনে নেয় না। তার পরও আবার গ্রামের মত জায়গা। পরিবার থেকেও সে সময় কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। স্বামী মারা যাওয়ার সময় তেমন কোন সম্পদ রেখে যাননি। তাই অর্থই সে সময় বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে যুব উন্নয়ন ও বিসিক অনেকটাই সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে তার জীবনে। ঢাকার বিভিন্ন হস্ত শিল্প মেলার জন্য পণ্য বানানোর মধ্যে দিয়ে শুরু করেন। সে সময় দৃঢ় মনোবল ও সাহসই ছিল তার বড় সঙ্গী। মোকসেদা বেগমের বর্তমান অবস্থা জানতে চাওয়া হলে শোনা গেল তৃপ্ত কন্ঠ। তিনি বলেন বর্তমান আমার এ প্রকল্পে কাজ করছে ২শ নারী। এখন মেলার পাশা পাশি ঢাকার বিভিন্ন শো-রুমে পাইকার হিসেবে পণ্য সরবরাহ করি। এ ছাড়া বিজিবি বা সেনাবাহিনীর বিভিন্ন দোকানেও আমার পণ্য যায়। পাশাপাশি ঠাকুরগাঁও শহরে একটি শো-রুম দিয়েছি। অনন্যা হস্ত শিল্পের পণ্যের এখন চাহিদা অনেক বেশি। কারণ আমি নিজেই তাঁতির কাছে কাপড় বানিয়ে তার ওপর নকশা করি। যার কারণে আমার বানানো পণ্য কোথাও পাওয়া যায় না। তবে এ ব্যবসাকে আরো বড় পরিসরে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে। বাংলাদেশের প্রান্তিক নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পেছনে সব চেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা অর্থ ও দিক নির্দেশনার অভাব এমনটাই মনে করেন মোকসেদা বেগম।
তিনি জানান, আসলে ব্যবসায় নামতে হলে কোন মাধ্যম থেকে পুঁজ ব্যবস্থা করা যাবে, সেটাই জানেন না অনেক নারী। বে-সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিলে টানতে হয় চড়া সুদ। সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঋণ সেবার তথ্য ভালো ভাবে পৌছানোর ওপড় গুরুত্মরোপ করেন মোকসেদা। তিনি উলেখ্য করেন, শুধু অর্থের জোগান হলেই হবে না। পণ্যের সঠিক বাজার জাতের পদ্ধতিও জানতে হবে। নিজের ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর পাশাপাশি মোকসেদার ঝুলিতে রয়েছে বেশ কিছু স্বীকৃতিও। ২০১১ সালে তিনি হস্ত শিল্পে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জাতীয় পুরস্কার গ্রহণ করেন। ২০১৩ সলে নারী উদ্যোক্তাদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব গ্রাস রুট উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউরস বাংলাদেশ মোকসেদাকে তুলে দেয় শ্রেষ্ঠ তৃণমূল নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার।
এ ছাড়া ঠাকুরগাঁও জেলা জয়িতা পুরস্কারও পেয়েছেন নিজের অগ্রণীয় ভুমিকার জন্য। মোকসেদা সপ্ন দেখেন অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়ানোর। তিনি বলেছেন সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছি বাকি জীবনটাও সংগ্রাম করে কেটে দেব অসহায়দের পাশে থেকে। তার কাজের দেখাশোনা করেন একমাত্র ছেলে মোকসেদুল ইসলাম।