পলিসিস্টিক ওভারির চিকিৎসা

পলিসিস্টিক ওভারির  চিকিৎসা

ডা: মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী :(সিনিয়র লেজার সার্জারী বিশেষজ্ঞ) প্রতি পাঁচ জনে এক জন মেয়েই পিসিওডি-র শিকার। তা  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ীই,এই পিসিওডি-র নেপথ্য কারণ কী? কেনই বা এত বাড়ছে এই অসুখ? পিসিওডি ও পিসিওএস নিয়ে জানালেন  বিশেষজ্ঞরা।
কী এই পিসিওডি ও পিসওএস?:


পলিসিস্টিক ওভারি ডিজিজকেই ছোট করে ডাকা হয় ‘পিসিওডি’। ‘পিসিওএস’-এর পুরো কথা পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম। পিসিওডি এবং পিসিওএস দুই ক্ষেত্রেই সমস্যাটি হরমোনের তারতম্যের হাত ধরে ঘটে। সাধারণত একটি বয়স অতিক্রম করার পর সব মেয়েরই ডিম্বাশয় থেকে প্রতি মাসেই ডিম নির্গত হয়। নিষেক না ঘটলে সেই ডিম দেহ থেকে বার হয়ে যায় রক্তের মাধ্যমে।


পিসিওডি-র ক্ষেত্রে এই ডিম নির্গত হওয়ার নিয়মটি নির্দিষ্ট রীতি মেনে হয় না। কখনও অপরিণত ডিম, কখনও বা আংশিক সম্পূর্ণ ডিমে ভরে যায় ডিম্বাশয়। এই অপরিণত ডিমগুলো দেহ থেকে বার হতেও পারে না। এক সময় সেই ডিমগুলোই জমে সিস্টের আকার নেয়। ছোট ছোট টিউমারের আকারে দেখতে এই সিস্টগুলো তরল বা অর্ধতরল উপাদান দিয়ে তৈরি।

চিকিৎসকের মতে, দু’টি ঋতুচক্রের মাঝে একটি ডিম্বাণু এসে হাজির হয় জরায়ুতে। কিন্তু ডিম্বাশয়ে সিস্ট থাকলে ডিম্বাণু সম্পূর্ণ হতে পারে না ও ডিম্বাশয় ছাড়িয়ে জরায়ুর দিকে এগোতেও পারে না। এ দিকে শুক্রাণু নিষিক্ত হওয়ার জন্য এসে পড়লেও তার উপযুক্ত ডিম সিস্টের ভিড়ে খুঁজেই পায় না। ফলে একটা সময়ের পর বিনষ্ট হয়ে যায়। ‘পলি’ কথার অর্থ অনেক।

অনেক সিস্ট ডিম্বাশয়ের উপর জমলে এই অসুখ বেশি করে দেখা যায়। চিকিৎসকরা বলছেন, ৬ মিলিলিটার পর্যন্ত ওজন হতে পারে এই সিস্টগুলির। প্রতি ডিম্বাশয়ে ১২-১৫টা সিস্ট আকারে দেখা দেয়। হরমোনের সমতাহীনতা, স্ট্রেস, ওবেসিটি যেমন এই অসুখ ডেকে আনে, তেমনই ডায়াবিটিক হলে ও খুব বেশি পরিমাণে বাইরের খাবার খেলে এর আশঙ্কা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। মূত্রনালির সংক্রমণ থেকেও হতে পারে ওভারিতে সিস্ট।


সাধারণত পিসিওসের ক্ষেত্রে ডিম্বাশয় থেকে প্রচুর মেল হরমোন নির্গত হয়। ফলে ডিম্বাশয়ে ধার ঘেঁষে ফোস্কার মতো সিস্ট জন্ম নেয়। এতে ডিমাশয় ভারী হয় তো বটেই, সঙ্গে মেল হরমোনের বাড়াবাড়ির দরুন শরীরে পুরুষালি বৈশিষ্ট্যও চোখে পড়ে। শরীরে রোম বাড়ে। গোঁফের রেখা দেখা দিতে পারে। ওজন বাড়ার কারণে নানা জটিলতা আসে। সঙ্গে ওভারিতে জায়গা কম থাকায় প্রজননেও নানা সমস্যা হয়। তবে পিসিওডি-র বেলায় ওজন বাড়া বা প্রজননের সমস্যা অনেক সময় হলেও এ সব মেল হরমোনের বাড়াবাড়ি থাকে না।


কী ভাবে বুঝবেন:
এই অসুখ দানা বাঁধলে বাইরে থেকে বিরাট কিছু জ্বরব্যধি হয় না। বরং শারীরিক কিছু মেয়েলি সমস্যা বাড়ে। তার মধ্যে প্রথমেই পিরিয়ডের সমস্যা দেখা দেয়। তার মানেই যে সব সময় খুব ব্যথাযুক্ত পিরিয়ড হবে, এমন নয়। অনেকেরই পেটে ব্যথা হয় না। বরং পিরিয়ডের আগে স্তন ভারী ঠেকে ও ব্যথা হতে পারে। কারও ক্ষেত্রে পেটে ব্যথা বেড়ে যায়।

পিরিয়ড খুব অনিয়মিত হয় কোনও কোনও সময়। আবার পিরিয়়ড নিয়মিত হলেও তা দীর্ঘায়িত হয়। প্রায় সব দিনই রক্তের পরিমাণ বেশি থাকে। পেটে যন্ত্রণা যাঁদের হয়, তাঁদের ক্ষেত্রে ব্লাড ক্লটও নির্গত হয়। পেটে ক্রাম্প ধরে অনেকেরই। তবে সকলেই যে খুব মোটা হয়ে যান এমন নয়, চেহারা শুকিয়ে গেলেও এই সব সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ ছাড়াও অবাঞ্ছিত চুল পড়া, শরীরে রোমবৃদ্ধি, ত্বকে ব্রণর সমস্যাও দেখা দেয় অনেক সময়।


রোগ নির্ণয়: 
পেটের আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করালেই ধরা পড়ে অসুখ।
-কোন বয়স বিপজ্জনক:সদ্য পিরিয়ড শুরুর পর মেয়েদের মধ্যে এই সমস্যা দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে ভারী চেহারার মেয়েরাই বেশি আক্রান্ত হয়। এর পর ২০-২৫ বছরের সময়, অর্থাৎ যাঁদের বিয়ের পর থেকেই সন্তানধারণের সমস্যা ও অনিয়মিত পিরিয়ড অথবা পিরিয়ডের সময় নানা জটিলতা লক্ষ্য করা গেলে এই অসুখে আক্রান্ত কি না তা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলে।

তবে সব সময় যে পিরিয়ড অনিয়মিত হবে বা ব্যথা থাকবেই এমন কোনও কথা নেই। এ ছাড়া ৩৫-৪০ বছরের মধ্যে ওজন বেশি, খাওয়াদাওয়ায় অনিয়ন্ত্রণ এই অসুখ ডেকে আনে। এন্ড্রোমেট্রিওসিস, গর্ভধারণের সময় নানা হরমোনজনিত সমস্যা, হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হওয়া থেকেও এই অসুখ দানা বাঁধে।


পিসিওডি নিয়ে এ দেশে মহিলারা যথেষ্ট সচেতন নন বলেই মনে করেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা,  এই অসুখ বেশি হয় অসচেতনতা থেকে। কর্মব্যস্ত যুগের দোহাই দিয়ে নিজস্ব খাওয়াদাওয়া ও ওজন কমানোর দিকটা মেয়েরা সব সময় মাথায় আনেন। তবে স্রেফ জিম করাই নয়, চাই ভিতর থেকে সুস্থতাও। তাই গর্ভধারণের সময় আজকাল এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় বেশির ভাগ মেয়েকেই। গর্ভাবস্থাতেও বাড়ে সিস্ট।


পিরিয়ডের সময় পেটে ক্রাম্প ও অত্যধিক ব্যথা এই রোগের অন্যতম লক্ষণ। 
শৈল্য চিকিৎসা:
মূলত শরীরে হরমোনের সমতা রক্ষা পায় না বলেই এই অসুখ হয়। কারও হঠাৎ ডায়াবিটিস বা থাইরয়েড ধরা পড়লে বা অন্য কোনও একটি হরমোনের আধিক্য দেখা দিলে বা রক্তক্ষরণ কমে গেলে এই রোগ আসে। রোগ ও রোগীর ধরন বুঝে চিকিৎসা শুরু করা হয়। সব সময় ওষুধ লাগে এমনটা নয়। এই রোগের চিকিৎসায় প্রথম থেকেই মেয়েদের গর্ভধারণে যাতে সমস্যা না হয়, সে দিকটা নজরে রেখেই চিকিৎসা করা উচিত। সাধারণত, জীবনযাপনে পরিবর্তন এনেই একে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ব্যায়াম ও ডায়েট দিয়ে ওজন প্রথমেই কমিয়ে আনা হয়। এতেই বে়ড়ে যায় ফার্টিলিটি রেট। ভয় ও ভাবনা অনেকটাই দূর হয়।

এ বার সেই ডায়েট বজায় রাখা, ওজন কমানোর জন্য শারীরিক কসরত এগুলো বজায় রাখা দরকার। এতেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাজ হয়। থাইরয়েড বা সুগার থাকলে সেই চিকিৎসা শুরু করার পর হরমোনের সমতা বিধান হয়ে অসুখ কমে যায় অনেক।

হরমোনাল ট্যাবলেট, ওরাল কিছু ওষুধ দেওয়া হয় কিছু ক্ষেত্রে। এই রোগের প্রভাবে ত্বকের নানা সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা আবার কিছু ক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেনের সঙ্গে অ্যান্টি মেল হরমোনেরও ওষুধও দেন।


প্রাথমিক স্তরে ক্লিটোরাল এনলার্জমেন্ট রোধ করাটাই চিকিৎসকদের কাজ হয়। এ ছাড়া এন্ড্রোজেনিক ওভার অ্যাকটিভিটি টেস্ট, হরমোনাল চিকিৎসা, লিপিড প্রোফাইলের স্তর সব কিছু দেখেশুনে চিকিৎসা শুরু করেন চিকিৎসকরা। তবে একটা বয়সের পর ওষুধে না কমতে চাইলে এন্ড্রোমেট্রিয়াল বায়োপ্সির দিকেও এগোন চিকিৎসকরা।

তবে সে সব বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছলে তবেই। সাধারণত পিসিওএস এবং পিসিওডির ক্ষেত্রে সার্জারির দরকার পড়ে না। তবে রোগীর অবস্থা অনুযায়ী ল্যাপ্রোস্কোপিক ওভারিয়ান ড্রিলিং ট্রিটমেন্ট করতে পারেন।
সমাধান কি?:
এই ধরনের রোগ থেকে রেহাই পাওয়ার মূল উপায় জীবনযাত্রার পরিবর্তন। স্ট্রেস দূরে রাখা, অন্তত ছ’-সাত ঘণ্টা ঘুম, ওজন নিয়ন্ত্রণ, বাইরের খাওয়াদাওয়া বন্ধ ও কোনও হরমোনাল অসুখের চিকিৎসা শুরু করলেই এই রোগ প্রায় নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

পিসিওএস, পিসিওডি সামলে নিয়েই কনসিভ করার কথা ভাবা ভাল।যোগ, নানা অ্যাবডোমিনাল এক্সারসাইজ, জগিং, জোরে হাঁটা, ব্যয়াম— যেগুলোতে পেটের মেদ ঝরে সে সব অভ্যাস করা, চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ডায়েট আর সঙ্গে হরমোনের অসুখ থাকলে তার চিকিৎসা করানো— এগুলোই এই অসুখ সারানোর মূল মন্ত্র
এছাড়ও 
লেপ্সরোস্কপিক ওভারিয়ান ড্রিলিং একটি কার্যকর পদ্ধতি -যাদের শুধু মাএ মেডিসিন প্রয়োগে তেমন ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না।অন্যদিকে চামড়ার উপরি ভাগ থেকে বা 
ট্রান্সভেজিনাল লেজার অ্যাবলেশন
 এর লেশন পদ্ধতিতে ও পলিসিসটিক ওভারীর কার্যকর চিকিৎসা হচ্ছে যা কিনা সর্বাধুনিক, তবে একজন বিশেষজ্ঞ লেজার চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়াটা উচিৎ।
লেখক ও পরামর্শক:
ডা: মােহাম্মদ ইয়াকুব আলী
লেজার সার্জারি বিশেষজ্ঞ  (অর্থোপেডিক রিউম্যাটোলজি)।
লেজার ও স্টেম সেল সার্জারিতে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও
ব্যবস্থাপনা পরিচালক: বিএলসিএস ইনস্টিটিউট আ্যন্ড হসপিটাল,
আফতাবনগর, বাড়ী-২,রোড-২,সেক্টর ২,ব্লক-ডি
,আফতাবনগর,ঢাকা।
ফোন: 
০১৭১৬১৪০৮৩৩,
০১৭৫১৯৩১৫৩০,