ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার ২২৮ কোটি টাকা

ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার ২২৮ কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক : গতিহীন হয়ে পড়েছে রাজধানীর এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুর পর্যন্ত যানজট নিরসনে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প। দফায় দফায় ব্যয় ও মেয়াদ বাড়িয়েও গতি আনা যাচ্ছে না। চার বছরের এ প্রকল্প বিভিন্ন কারণে কয়েক ধাপে মেয়াদ বাড়িয়ে সাড়ে নয় বছর বাড়ানো হয়েছে। এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে আট বছর। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়েছে ৩৭ শতাংশ।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মূল অনুমোদিত ব্যয় থেকে বেড়ে গেছে ২ হাজার ২২৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এতবার বাড়ানোর পরও নির্ধারিত সময়ে এটি বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির পঞ্চম সভায় উল্লিখিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে সম্প্রতি ‘গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’টির ওপর সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন (আইএমইডি) বিভাগের সাবেক সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘টাইম ওভার রান’ হলে অবশ্যই ‘কস্ট ওভার রান’ হবেই। অর্থাৎ সময় বাড়লে খরচ বাড়বেই। কেননা এ সময়ের মধ্যে মূল্যস্ফীতি হয়, শ্রমিকদের মজুরি বাড়ে এবং পণ্যের দাম বেড়ে যায়। তা ছাড়া সাধারণত দুই বছর পরপর রেট শিডিউল পরিবর্তন হয়। এই ‘রেট শিডিউল’ পরিবর্তন হলে বেশ বড় অঙ্কের ব্যয় বেড়ে যায়।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (আরবান ট্রান্সপোর্ট অনুবিভাগ) নীলিমা আখতার শনিবার বলেন, অনুমোদনের পর নানা কারণে প্রকল্পটির কাজ শুরু করতেই দেরি হয়েছিল। এ ছাড়া মাল্টি স্টেকহোল্ডারের কারণে বারবার ডিজাইন পরিবর্তন করতে হয়। সেই সঙ্গে এ প্রকল্পটিতে এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, সেতু বিভাগ এবং সিটি করপোরেশনসহ একাধিক সংস্থা যুক্ত রয়েছে। তাই এটির বাস্তবায়ন বিলম্ব হলেও এখন কোনো সমস্যা নেই। বর্তমানে ভালোভাবেই কাজ এগিয়ে চলছে। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে।

সূত্র জানায়, বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১২ সালে। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই হাজার ৪০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। সেটি না হওয়ায় প্রথম দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। সে সময় প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এরপর আরেক দফায় ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এ সময় ব্যয় বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। করোনার কারণে আবারও সময় বাড়ানো হয়। কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২০২২ সালের জুনে। 

গত ২৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্পটির স্টিয়ারিং কমিটির সভা। ওই সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, সভায় প্রকল্প পরিচালক সার্বিক অগ্রগতি সম্পর্কে তুলে ধরেন। এ সময় তিনি জানান, প্রকল্পের আওতায় পূর্ত কাজের চারটি প্যাকেজের মধ্যে সবগুলো প্যাকেজের নির্মাণকাজ চলমান আছে। গত অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ২৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি ৩৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এছাড়া বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের অংশের মধ্যে ৬ লেনবিশিষ্ট সাড়ে চার কিলোমিটার এলিভেটেড অংশ, সাড়ে চার কিলোমিটার অ্যাট গ্রেড সড়ক, ১০ লেনের টঙ্গী সেতু এবং ৬টি বিআরটি স্টেশন নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কার্যবিবরণীতে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় নিয়োজিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জিনাগসু প্রভিনসিয়াল ট্রান্সপোটেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড (জেটিইজি) ২০১৫ সালে ডিজাইন সম্পন্ন করে। আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে নির্বাচিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান জেটিইজির সঙ্গে ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের ৯৩৫ কোটি টাকার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সাড়ে চার কিলোমিটার এলিভেটেড অংশ এবং ৮টি র‌্যাম্পে মোট ১৬৩টি স্প্যান আছে। এর মধ্যে ৭৮টি স্প্যানে আইগার্ডার এবং ৮৫টি স্প্যানে বক্সগার্ডারের সংস্থান রয়েছে। টঙ্গী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কটি অত্যন্ত ব্যস্ত করিডর। প্রায় ২১টি জেলার সঙ্গে এ করিডর যুক্ত। ২০১৪ সালের তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন উভয় দিক দিয়ে ৩৬ থেকে ৪৪ হাজার যানবাহন এবং বর্তমানে ৬০ হাজার গাড়ি এ মহাসড়কে চলাচল করে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা পিইসি সভায় বলেন, এমন একটি ব্যস্ত মহাসড়কে যানবাহন চলাচল অব্যাহত রেখে বক্সগার্ডার স্থাপন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া করিডরটিতে বিভিন্ন ধরনের ইউটিলিটি লাইন যেমন গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, অপটিক্যাল ভাইবার লাইন ইত্যাদি মাটির ওপরে-নিচে জালের মতো ছড়ানো রয়েছে। এ ছাড়া দুটি ঈদ ও ইজতেমা চলাকালীন কোনোভাবেই কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। এরই মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী গত জুন মাসে ঠিকাদারের মেয়াদ (৩০ মাস) পার হয়েছে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত পাইলিং কাজ ৫৫ শতাংশ, পাইল ক্যাপ ৪৫ শতাংশ, পিয়ার স্টেম ৪৫ শতাংশ এবং ড্রেইনেজ কাজ ৯৮ শতাংশ শেষ করতে পেরেছে।

পিইসি সভার কার্যবিবরণীতে আরও বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পটির ওপর ২০১৯ সালের ১৭ জুন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তৃতীয় প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির সভা। ওই সভায় প্রকল্পের বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের অংশে এলিভেটেড স্প্যানের বক্সগার্ডারের পরিবর্তে আইগার্ডার ব্যবহার করার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু সেটি বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে যথার্থ না হওয়ায় বিদ্যমান ডিজাইনেই এলিভেটেড অংশের নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু সেটি না করে পুনরায় প্রকল্পে এলিভেটেড স্প্যানের বক্সগার্ডারের পরিবর্তে আইগার্ডার ব্যবহারের প্রস্তাব করা হলে এ বিষয়ে পিইসি সভায় ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে সড়ক ও জনপথ অংশের প্রকল্প পরিচালক বলেন, ওই সময় আমরা বিষয়টি ভালোভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনি। সভায় আরও জানানো হয়, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান জেটিইজি কাজ শুরুর প্রথম থেকেই সড়কে অপ্রশস্ততার কারণে গাড়ি চলাচল অব্যাহত রেখে বক্সগার্ডার নির্মাণ অত্যন্ত কঠিন বলে কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে আসছে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কর্ণফুলী টানেলের কন্ট্রাক্ট স্পেশালিস্ট গুপ্ত এবং ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের প্যানেল অব এক্সপার্ট কমিটির মতামত গ্রহণ করে। তারা বলেছেন, জেটিইজির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির অনুচ্ছেদ ১৩ দশমিক ২ অনুযায়ী ভ্যালু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের সুযোগ আছে। এভাবে নানা বিষয় খতিয়ে দেখার পর এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কোনো গার্ডার দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে করা হবে এ বিষয়ে সভায় বিস্তারিত আলোচনার পর আইগার্ডারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে বলা হয়, আইগার্ডারের কারণে নিয়োজিত ঠিকাদার কোনো অবস্থাতেই আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন না। কিংবা এ ধরনের কোনো দাবি উত্থাপন করতে পারবে না। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে বক্সগার্ডারের পরিবর্তে আইগার্ডার স্থাপনের যৌক্তিকতা সংক্রান্ত একটি লিখিত প্রতিবেদন সরবরাহ করতে হবে।

বি আলো / মুন্নী