শিথিল লকডাউনে করোনা হাসপাতালে বিপর্যয়

শিথিল লকডাউনে করোনা হাসপাতালে বিপর্যয়

***জেলায় জেলায় অক্সিজেন সংকট

***রয়েছে ওষুধ সংকটের অভিযোগ

***অধিকাংশ আক্রান্তেরই ডেলটা ভেরিয়েন্ট

*** বেড না পেয়ে রোগী নিয়ে টানাহেঁচড়া 

***সাধারণ চিকিৎসা ব্যাহত, হিমশিম খাচ্ছে সাস্থ্যকর্মীরা,

***গরুর হাট থেকে শুরু করে ঈদযাত্রা কোথাও নেই স্বাস্থ্যবিধি

***করোনার লাগাম টানাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ

মেহেদী হাসান: প্রতিদিনই দেশজুড়ে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে করোনা সংক্রমণ। চলতি মাসে কঠোর লকডাউনের মাঝেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি সংক্রমণ। এর মধ্যেই ঈদকে সামনে রেখে ও মানুষের জীবন জীবিকার তাগিদে ঈদ পূর্ববর্তী সময়ে লকডাউন শিথিল করে সরকার। তবে দেশের সব এলাকাতেই ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে করোনার ডেলটা ভেরিয়েন্ট (করোনার ভারতীয় ধরন)। সকল করোনা হাসপাতালে দেখা দিয়েছে রোগীর বাড়তি চাপ। হাসপাতালগুলোতে সংকট দেখা দিয়েছে আইসিইউর, রয়েছে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সংকট, বেড না পেয়ে অনেক রোগীকে এক হাসপাতাল থেকে টানাহেঁচড়া করে নেওয়া হচ্ছে অন্য হাসপাতালে। চিকিৎসার অভাবেও মারা যাচ্ছেন অনেকে। করোনা রোগীদের চাপ সামাল দিতে গিয়ে হাসপাতালগুলোতে ব্যাহত হচ্ছে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা। ইতিমধ্যে পর্যাপ্ত সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে সাস্থ্যকর্মীরা।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন লকডাউন শিথিলতায় করোনার ঝুঁকি মারাত্মক আকারে বাড়ছে।

রাজধানীতে বেড়েছে পূর্বের চেয়েও তীব্র যানজট, দোকানপাঠ থেকে শুরু করে খোলা রয়েছে মার্কেট ও সকল গার্মেন্টস কারখানা, তবে কোথাও নেই স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই। মাঠপর্যায়ে গণসমাগম কমাতে দেখা যাচ্ছে না পুলিশ প্রশানকে, নৌরুট থেকে রেল স্টেশন ও বাস স্টেশনগুলোতে নেই যেন করোনার ভীতি, গরুর হাটগুলো যেন হচ্ছে করোনার সংক্রমণ বাড়ার বাজার। কয়েকদিনের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, করোনা সংক্রমণে মৃত্যুর হার কিছুটা কমলেও বাড়ছে সংক্রমণের হার। দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ছাড়াচ্ছে ৮ হাজারেরও বেশি। রাজধানীর ৬টি করোনা হাসপাতালে রোগীদের জন্য কোনো আইসিইউ বেড ফাঁকা নেই বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পাশাপাশি সাধারণ বেডগুলোতেও প্রতিদিনই বাড়ছে রোগীর চাপ। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, রাজধানীর ১৬টি করোনা হাসপাতালের মধ্যে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতাল এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হলেও নেই আইসিইউ’র ব্যবস্থা। 

এদিকে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউগুলোও এখন কানায় কানায় ভর্তি। রাজধানীর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে প্রতিদিনই বিভিন্ন জেলা থেকেও আসছে করোনা রোগী। গতমাসে সারাদেশে হাসপাতালে করোনা রোগীদের সাধারণ শয্যায় রোগী ভর্তি বেড়েছিল ২৮ শতাংশ, আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তি বেড়েছিল ২৬ শতাংশ। ঢাকার সরকারি হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় রোগী বেড়েছিল  ২২ শতাংশ এবং আইসিইউতে রোগী বেড়েছিল ৪ শতাংশের একটু বেশি। তবে চলতি মাসে হঠাৎ করেই যেন রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। ঢাকায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে নেই চাহিদা অনুযায়ী আইসিইউ। রোগীর চাপে সাধারণ শয্যাগুলোও যেন সংকটের মুখে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। বরিশালে করোনা রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় হিমসিম খাচ্ছে স্বাস্থ্যসেবীরা। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে। বেড খালি না থাকায় মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে রোগীকে । এ অবস্থায় জেলা সদর হাসপাতালে আরো একটি করোনা ইউনিট চালু করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। 

হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত করোনা চিকিৎসার পর্যাপ্ত ওষুধ নেই। অনেকে আবার অর্থাভাবে ওষুধ কিনেও খেতে পারছেন না বলেও জানা গেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন অনেক সময় সকল ওষুধ করোনা রোগীদের দেওয়া হয় না। স্বাস্থ্যের ধরন অনুযায়ী তাদের নির্দিষ্ট ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। তবে রোগীর বাড়তি চাপ থাকায় কিছুটা সংকট দেখা দিলেও তা সরবারহ করা হচ্ছে।

বিএমএর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব জানিয়েছেন, ভারতীয় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য বিভাগ সীমান্ত লাগোয়া সাত জেলায় লকডাউনের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সেটি সরকার কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করেনি। ধাপে ধাপে সীমান্ত জেলা থেকে সংক্রমণ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। লকডাউন শিথিলতায় মানুষের অবাধ বিচরণের ফলে করোনা পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।  

কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে পশুর হাটগুলো খুলে দেওয়া হলেও বেশকিছু শর্ত ও বিধিবিধান মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়। যার প্রধান বিষয় হলো পশুর হাটগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে। করোনা রুখতে মাস্ক বাধ্যতামূলক পরতে হবে, রাখতে হবে শারীরিক দূরত্ব। তবে এসব বিধিবিধানের কথা হয়তো সবাই ভুলে গেছেন। দেশের সব হাটই এখন চলছে গাদাগাদি অবস্থায় উপচেপড়া ভিড়, মানুষ ও কোরবানির পশু একাকার হয়ে বারাচ্ছে করোনার ঝুঁকি। রাজধানীর অধিকাংশ হাটেই মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। হাটগুলোর প্রবেশপথে নেই হাত ধোয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। নেই মানুষের শরীরের তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র। কয়েকটি হাট পরিদর্শন করে দেখা যায়, হাটগুলোতে ক্রেতা বিক্রেতা ও কোরবানির পশু যেন গদাগাদি করে কেনাবেচা করছেন। অনেকেরই মুখেই দেখা যায়নি মাস্ক। কোন কোন আবার পরিবারের সকলকে নিয়ে পশু কিনতে এসেছেন। পশু কিনতে আসা এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, হাটে প্রচুর গরম থাকায় মাস্ক পরা সম্ভব না। তাই মাস্ক খুলে ফেলেছেন। এমন অবস্থা অনেকের মাঝেই। শাহজাহানপুর, মেরাদিয়া, বছিলা, গোপীবাগ বালুর মাঠ, দনিয়া কলেজ মাঠ, ধূপখোলাসহ অধিকাংশ হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে। এ অবস্থায় কোরবানির পশুর হাট থেকে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

অর্ধেক যাত্রী বহনের কথা থাকলেও পরিবহনে উঠছে অতিরিক্ত যাত্রী। বাস, ট্রেন কিংবা লঞ্চ টার্মিনালগুলোতে নেই জীবাণু নাশক ছিটানোর ব্যবস্থা। লঞ্চ কর্তৃপক্ষকে প্রবেশ পথে হ্যান্ড স্যানিটাইজার স্প্রে করতে দেখা যাচ্ছে না, অনেকের মুখেই নেই মাস্ক ও সামাজিক দূরত্বের বালাই। তবে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও লঞ্চ মালাকিরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ মেনেই লঞ্চ ছাড়া হচ্ছে।   

বিআলো/ইলিয়াস